Shopnobilap
স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয়ের উল্লাস

সত্য ঘটনা অবলম্বনে “বিজয়ের উল্লাস”

স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয়ের উল্লাসখলিফাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মোঃ সৌকতুল্লাহ সরকার আর গোলেনুর বেগমের ৮ছেলে আর ২মেয়ে। ১৯৬৬ সালে তাদের ৬ষ্ঠ তম ছেলে মোঃ আমিরুল ইসলাম সেনাবাহিনীতে সৈনিক পদে চাকরি পান। চাকরি পাওয়ার এক বছর পর আমিরুল ঐ গ্রামেরই মরিয়ম নামের এক মেয়ে কে বিয়ে করেন। বিয়ের পর আমিরুল মরিয়ম কে বাড়িতে মা, ভাই, ভাবি সবার কাছে রেখে চাকরিতে চলে যায় ছুটি পেলে কিছু দিন বাড়িতে থেকে যেতো। এই ভাবেই ৪বছর কেটে যায়।                                                                                                                                 ১৯৭১ সাল। আমিরুল বাড়িতে এসে মরিয়মকে বলে- তোমাকে এবার সাথে করে নিয়ে যাবো। আমি যেখানে চাকরি করি তুমিও আমার সাথে সেখানে থাকবে। নতুন জায়গা মরিয়ম সারা দিন একা বাসায় থাকবে তাই আমিরুলের এক রড় ভাইয়ের মেয়ে কোহিনুর কে সাথে করে নিয়ে যায়।কোহিনুরের তখন ৭-৮বছর বয়স হবে। আমিরুল তখন চট্টগ্রাম চাকরি করতো। মরিয়ম আর কোহিনুর কে চট্টগ্রাম নিয়ে যায়। ওরা ভাড়া বাসায় থাকতো।

চারিদিকে তখন যুদ্ধের সরোগোল পড়ে যায়। পাকিস্তানীদের সাথে যুদ্ধের ডাক দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশ কে স্বাধীন করতে হবে। পাকিস্তানীদের সাথে মুক্তিবাহিনীরর শুরু স্বাধীনতা যুদ্ধ।

মরিয়ম আর কোহিনুরের চট্টগ্রাম যাওয়ার মাত্র ১২ দিন হয়েছে। একদিন আমিরুল বাসা থেকে কাজে বের হয়ে গেছে। ছোট কোহিনুর কে নিয়ে মরিয়ম বাসায় আছে। হঠাৎ শুরু হয়ে যায় গোলাগুলি। অনেক জায়গায় জ্বলে উঠে আগুন। জানালার কাচ ভেঙ্গে একটা গুলি এসে পড়ে ঘরের মেঝেতে। মরিয়ম ভয় পেয়ে কোহিনুরের হাত ধরে বাসা থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে। আশে-পাশের আরো অনেক মানুষ এসে জড়ো হয় এক জায়গায়। সবাই বলে, এখনি এখান থেকে পালাতে হবে। তা না হলে মিলিটারিরা সবাইকে মেরে ফেলবে। বাসা থেকে কোনো কিছু নেওয়ার মতো সময় নেই তাই সবাই এক কাপড়ে পালানোর জন্য প্রস্তুত হয়। কিন্তু মরিয়ম যেতে রাজি হয় না। মরিয়ম বলে, আগে আমার স্বামী ফিরে আসুক। আপনারা যান, আমি ওকে ছাড়া কোথাও যাবো না। সবাই বলে, ভাবি এই ছোট মেয়েকে সহ আপনাকে এই বিপদের মধ্যে রেখে আমরা কিভাবে যাই। আপনি আমাদের সাথে চলুন। রাস্তায় যদি আপনার স্বামীর সাথে দেখা হয়ে যায় তাহলে তো খুবই ভালো। আর যদি দেখা না হয় তাহলে আপনাদের দুজনকে গ্রামের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের। একজন দৌড়ে এসে বলে, তারাতারি সবাই পালান মিলিটারিরা এই দিকেই আসছে। মরিয়ম সবার কথা শুনে অনিচ্ছা সত্ত্বেও যেতে রাজি হয়। সবাই এক বস্ত্রে ওখান থেকে হেঁটেই রওনা হয়। কারো সাথেই খাবার কোনো কিছুই ছিল না। না খেয়েই সবাই হেঁটে চলেছে। কখনো হাঁটছে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে, কখনো বা সমুদ্রের তীর দিয়ে। সবাই ক্লান্ত হয়ে মাঝে মাঝে কোনো এক গাছের নিচে বসে কিছুক্ষণ জিরিয়ে আবার চলতে শুরু করছে

অন্যদিকে আমিরুল পাগলের মতো মরিয়ম আর কোহিনুর কে খুঁজছে। মরিয়মরা দল বেঁধে সমুদ্রের তীর দিয়ে হাঁটছে। একটু দুরেই একটি গ্রাম দেখা যাচ্ছে। গ্রামের নাম নিউ পতেঙ্গা। গ্রামের ওদিক থেকে দুজন লোক এগিয়ে আসছে মরিয়মদের দিকে। এসে বলে- ঐ গ্রামের চেয়ারম্যান সাহেব আপনাদেরকে আমাদের সাথে যেতে বললেন। সবাই ভাবে এরা যদি মিলিটারিদের লোক হয় তাহলে তো আমাদেরকে মেরে ফেলবে। তাই লোক দুটোকে বলে দেয় আপনারা চলে যান আমরা যাবো না। লোক দুটো চলে যায়। সবাই আবার হাঁটতে শুরু করে। একটু পর লোক দুটো আবার আসে। বলে- আপনারা ভয় পাবেন না। সত্যি ঐ গ্রামের চেয়ারম্যান সাহেবই আপনাদের ডেকে পাঠিয়েছে। তখন সবাই ভাবে গিয়ে তো দেখি কপালে যা আছে তাই হবে। সবাই লোক দুটোর সাথে যায়। গিয়ে দেখে সত্যি ওটা এক চেয়ারম্যান এর বাড়ি। চেয়ারম্যান সাহেব সব ছেলেদের বাইরের কাচারি ঘরে বসতে দেয়। আর মেয়েদের বাড়ির ভেতরে পাঠায়। সবার জন্য খাবারের ব্যবস্থা করতে বলেন। বাড়িতে চেয়ারম্যান সাহেবের মা আর স্ত্রী ছিল। ওনারা খুব ভালো মানুষ। সবাইকে খাওয়ার আর বিশ্রামের ব্যবস্থা করে দেন। চেয়ারম্যান সাহেব বলেন, আপনারা সবাই আমার বাড়িতে দুই এক দিন থাকুন তার পর আবার রওনা হবেন। চেয়ারম্যান সাহেবের লোকজন গ্রামের সব বাড়ি থেকে কিছু পুরোনো কাপড় এনে সবাইকে দেয়। মরিয়ম বসে খুব কাঁদছিল। চেয়ারম্যান সাহেবের মা এসে বলেন, তুমি এতো কাঁদছো কেন মা? মরিয়ম বলে, আমার স্বামীকে হারিয়ে ফেলেছি। তারপর কিভাবে এখানে আসলো সব খুলে বলে। চেয়ারম্যান সাহেবের মা জড়িয়ে দরে সান্ত্বনা দেয়। তারপর ছেলেকে গিয়ে বলেন, ঐ মেয়েটা খুব কাঁদছে ওর স্বামীকে তুই যেভাবেই পারিস খুঁজে দে বাবা। চেয়ারম্যান সাহেব বলেন, ওনাকে বলো ওনার স্বামীর নাম ঠিকানা সব একটা কাগজে লেখে যেন আমাকে দেয়। তাহলে আমি ওনার স্বামীকে খোঁজার চেষ্টা করবো। চেয়ারম্যান কে মরিয়ম নাম ঠিকানা সব লেখে দেয়।

মরিয়ম নামায পড়ে জায়নামাজেই বসে কাঁদছে। বাইরে কয়েকজন লোক এসে একটু পানি চায়। চেয়ারম্যান সাহেব তাদের কাচারি ঘরে বসতে দিয়ে পানি আর কিছু খাবার খেতে দেয়। চেয়ারম্যান সাহেব মরিয়মের লেখা কাগজ টা একজন লোকের হাতে দিয়ে বলেন, দেখুন তো এই নামের মানুষ টিকে চিনেন কি না? আমাদের এখানে একটি মহিলা আছেন ওনার স্বামীকে হারিয়ে ফেলেছেন। কাগজে ওনার স্বামীর নাম ঠিকানা লেখা আছে। লোকটি লেখা দেখেই কাগজ টি বুকের সাথে জরিয়ে ধরে। আর দুচোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে আসে। চেয়ারম্যান সাহেব বলেন, কি হয়েছে আপনি কাঁদছেন কেন? লোকটি চোখ মুছে বলে, এই কাগজে যার নাম ঠিকানা লেখা আমিই সেই মানুষ। আমার স্ত্রী আর ভাতিজি কে খুঁজতে খুঁজতে আপনার এখানে এসেছি। চেয়ারম্যান সাহেব ভেতরে মরিয়মের কাছে খবর পাঠায়। মরিয়ম জায়নামাজ থেকে উঠে বাইরে এসে দেখে আমিরুল দাড়িয়ে আছে। ওরা দুজন দুজনকে দেখে খুব কাঁদে। সেই দিন সবাই চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়িতেই থাকে। পরের দিন গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়। চেয়ারম্যান সাহেব এসে বলেন, আপনাদের এখানে আর রাখতে পারলাম না। মিলিটারিরা যে কোনো সময় এখানে চলে আসতে পারে। আপনারা তারাতারি পালিয়ে যান।

তখন দল বেঁধে সবাই আবার বেরিয়ে পরে। আবার শুরু হয় সমুদ্রের তীর, জঙ্গল দিয়ে হাঁটা। রাস্তায় একটা বাসের দেখা পেয়ে সবাই বাসে ওঠে। বাস চলতে শুরু করে। পাবনা এসে ড্রাইভার বলে, বাস নিয়ে আর যাওয়া যাবে না। বাস নিয়ে আর একটু এগিয়ে গেলে মিলিটারিরা বাসে আগুন জ্বালিয়ে দেবে। আপনারা বাস থেকে নেমে যান। সবাই বাস থেকে নামে। আমিরুল মরিয়ম আর কোহিনুর কে নিয়ে একটি রিক্সায় উঠে। রিক্সায় কিছুটা যেতেই দুজন লোক এসে রিক্সার সামনে দাঁড়ায়। রিক্সা থামিয়ে আমিরুলকে বলে, আপনাকে এখনি আমাদের সাথে যেতে হবে। আমিরুল যেতে রাজি হয় না কিন্তু লোক দুটো জোড় করায় আমিরুল মরিয়মকে রিক্সায় অপেক্ষা করতে বলে ওদের সাথে যায়। অনেকক্ষণ হয়ে যাচ্ছে কিন্তু আমিরুল ফিরে আসছে না। মরিয়ম খুব ভয় পেয়ে যায়। প্রায় ঘন্টা খানিক পর আমিরুল ফিরে আসে। মরিয়ম বলে, তুমি কোথায় গিয়েছিলে এত দেরি হলো কেন? আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আমিরুল- ওরা রাজাকার। আমাকে মিলিটারিদের কাছে নিয়ে যাচ্ছিল। আমি বুঝতে পেরে পালিয়ে এসেছি। তারাতারি এখান থেকে যেতে হবে। তারপর আমিরুল ওদের নিয়ে পাবনায় এক বড় ভাইয়ের বাসায় যায় আশ্রয়ের জন্য। কিন্তু গিয়ে দেখে বাসায় কেউ নেই। বাসায় তালা দিয়ে সবাই মিলিটারিদের ভয়ে অন্য জায়গায় পালিয়ে গেছে। আশে-পাশের বাড়ি ঘর দেখে বোঝা যাচ্ছে যে মিলিটারিরা এখানকার সব বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল।

আমিরুল ওদের নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। আসার পথে নাটোর আমিরুলেরর এক বন্ধুর বাড়িতে খাওয়া দাওয়া করে আবার রওনা দেয়। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে অনেক কষ্ট করে ওরা খলিফাপাড়া মরিয়মের বাবার বাড়ি এসে পৌঁছায়। মরিয়মের বাবা মা আমিরুল কে বলে, অনেক রাত হয়ে গেছে আজ এখানেই থেকে যাও। কিন্তু আমিরুল বলে, না আমি আগে বাড়ি গিয়ে কোহিনুর কে ওর বাবা মার কাছে পৌঁছে দেবো। আমিরুল কোহিনুর কে নিয়ে বাড়ি চলে আসে। কিছুদিন পর মরিয়মকেও বাড়ি নিয়ে এসে বাড়িতেই থাকে। আমিরুল বাড়িতে থেকেই লবনের ব্যবসা করতে শুরু করে। আর গোপনে করে মুক্তিযুদ্ধে কাজ।

কয়েক দিন পর আমিরুল খবর পায় যে মিলিটারিরা তাকে ধরতে আসবে। খবরটি পেয়েই আমিরুল মা আর স্ত্রীরর সাথে কথা বলে পালিয়ে খুবজীপুর বোনের বাড়িতে চলে যায়। মিলিটারিরা আমিরুল কে না পেয়ে তার অন্য দুই ভাইকে ধরে নিয়ে যায়। আর বলে, সৈনিক আমিরুল যদি আত্মসমর্পন করে তাহলে তার দুই ভাইকে ছেড়ে দেবে। তখন আমিরুলের আরেক বড় ভাই মরিয়মকে জিজ্ঞাসা করে যে, আমিরুল কোথায়? মরিয়ম বলে, জানি না। বড় ভাই বলে আমার মনে হয় আমিরুল খুবজীপুরই গেছে। তারপর একটা লোক কে পাঠায় খুবজীপুর বোনের বাড়িতে। লোকটিকে বলে, আমিরুল কে গিয়ে বলবে ও যেন তারাতারি বাড়ি চলে আসে। আমিরুল খবর পেয়ে বাড়ি চলে আসে।

বড় ভাই আমিরুল কে বলে, তুই মিলিটারিদের কাছে আত্মসমর্পন কর তা না হলে ওদের দুজন কেই মিলিটারিরা মেরে ফেলবে। তোর একার জন্য ওদের দুজনকেই মরতে হবে। তোর তো এখনো ছেলে মেয়ে হয়নি কিন্তু ওদের ছেলে মেয়ে আছে।

আমিরুল- ঠিক আছে আমার জন্য কাউ কে মরতে হবে না। আমি আজই আত্মসমর্পন করবো।
আমিরুল ঘরে যায় মরিয়মেরর সাথে কথা বলতে।
মরিয়ম- একটা ভালো খবর আছে তোমার জন্য। আমি মা হতে চলেছি।
কথাটা শুনে আমিরুলের দুচোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে আসে।
মরিয়ম- কি হয়েছে কাঁদছো কেন তুমি খুশি হওনি?
আমিরুল- খুব খুশি হয়েছি। কিন্তু এখনি আমাকে যেতে হবে। মিলিটারিদের কাছে আত্মসমর্পন করতে হবে।
মরিয়ম- না আমি তোমাকে যেতে দেবো না।
আমিরুল- আমাকে বাঁধা দিওনা। আমাকে যেতেই হবে। তুমি হাসি মুখে আমাকে বিদায় দাও।
মরিয়ম- তুমি আবার আমার কাছে ফিরে আসবে তো?
আমিরুল- আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করো। তোমার ভালোবাসা আমাকে ঠিকি ফিরিয়ে আনবে।
আমিরুল মরিয়মকে সান্ত্বনা দিয়ে কথাগুলো বললেও মনে মনে জানতো যে তার আর কখনো ফেরা হবে না। একবার গিয়ে আত্মসমর্পন করলে মিলিটারিরা তাকে আর বাঁচিয়ে রাখবে না। তারপরেও মরিয়মকে সান্ত্বনা দিয়ে আমিরুল চলে যায়। মরিয়ম খুব কাঁদে।

আমিরুল গিয়ে আত্মসমর্পন করে। মিলিটারিরা তার দুই ভাইকে ছেড়ে দেয়। মরিয়মের কাছে প্রতিটি দিনই যেন বছরের মতো কাটতে থাকে।

মিলিটারিরা আমিরুল সহ অনেকজন কে নাটোর জেলে আটকে রাখে। তাদের কে মিলিটারিরা খুব মার ধোর করতো। এই ভাবেই কিছু দিন কেটে যায়।

আমিরুল দেখতো মিলিটারিরা রাতে কয়েক জন এসে একজন কে ডেকে নিয়ে যেতো। বলতো তাদের বড় অফিসার ডাকছে। যাকে ডেকে নিয়ে যেতো সে আর ফিরে আসতো না। আমিরুলেরা বুঝতে পারে যে মিলিটারিরা রোজ রাতে একজন করে ডেকে নিয়ে গিয়ে তাকে মেরে ফেলতো। এভাবে আস্তে আস্তে জেলে আটকে থাকা লোক সংখ্যা কমতে থাকে। আমিরুল ভাবে এইভাবে একদিন তাকেও ডেকে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলা হবে। কিন্তু এত সহজেই কি হার মেনে নিবে। শেষ বারের মতো কি একবার বাঁচার চেষ্টা করবে না। মরিয়ম যে তার অপেক্ষায় পথ চেয়ে আছে।

জেলে আটকে থাকা লোক কমতে কমতে আমিরুলরা আর কয়েক জন বাকী আছে। ওরা কয়েক জন মিলে পরিকল্পনা করে যে বাঁচার জন্য একবার শেষ চেষ্টা করবে। ওদের কয়েক জনের কাছে গাঁয়ে দেওয়ার জন্য একটি করে চাদর ছিল। ওরা সে সব চাদর দিয়ে গিট বেঁধে বেঁধে তসবির মতো তৈরি করে। তারপর ২-৩ জন মিলে উচ্চ শব্দে চাদরের তৈরি তসবি দিয়ে জিকির করতো। যাতে তারা রুমে কোনো শব্দ করলে তা মিলিটারিরা শুনতে না পায়। ওরা সুযোগ বুঝে একদিকে শব্দ করে তসবি পড়তো অন্যদিকে ২-৩ জন মিলে দেয়ালের এক পাশের ইট ভাঙ্গতো। মিলিটারিরা যাতে ভাঙ্গা দেয়াল দেখতে না পায় তাই সেখানে কাপড় শুকাতে দিয়ে আড়াল করে রাখতো। কয়েক দিনের মধ্যে একজন মানুষ বের হওয়ার মতো দেয়াল তারা ভেঙ্গে ফেলে। মিলিটারিদের একজন এসে আমিরুলদের জানায় যে তোমরা যে কয়জন আছো আজ রাতে অফিসার তোমাদের সবাইকে এক সাথে ডেকেছ রাতে, তোমরা তৈরি থেকো। তারা বুঝতে পারে যে আজকের রাতই তাদের জীবনের শেষ রাত হতে চলেছে। আজ তাদের সবাইকে এক সাথে মেরে ফেলা হবে। তাই তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে, রাতে মিলিটারিরা ডাকার আগেই কিছু একটা করতে হবে। সারা দিন কেটে যায়। সন্ধ্যা হয়ে যায়। চারিদিকে আঁধার ঘনিয়ে আসে। আমিরুল বলে এই সুযোগ। আমাদের এখনি পালাতে হবে। তখন ওরা দেয়ালের ভাঙ্গা দিয়ে একে একে সবাই ঘরের বাহিরে বের হয়। কিন্তু চারিদিকে অনেক লম্বা প্রাচীর। এখন প্রচীর পার হবে কিভাবে?

তখন তারা সবাই মিলে তসবি বানানো চাদর গুলোর গিট খুলে একটার সাথে আরেকটা বেঁধে দড়ির মতো তৈরি করে। তারপর এক জনের পিঠের ওপর আরেক জন তার পিঠের ওপর আরেক জন এইভাবে এক জনকে প্রাচীরের ওপারে পার করে দেয়। সে প্রাচীরের ওপার থেকে চাদরটা ধরে রাখে আর এপার থেকে একে একে সবাই প্রাচীর পার হয়ে ঐ পারে চলে যায়। সঙ্গে সঙ্গে তারা শুনতে পায়। বন্দুকের গুলির শব্দ। তারা বুঝতে পারে যে, মিলিটারিরা তাদের পালানোর বিষয় টের পেয়ে গেছে। তাই তারা সবাই বাঁচার জন্য সেখান থেকে দৌঁড়ানো শুরু করে। এক সময় যে যার বাড়ি পৌঁছে যায়।

দীর্ঘ ৫ মাস জেলে আটকে থাকার পর অবশেষে আমিরুল মরিয়মের কাছে ফিরে আসে। কিছু দিনের মধ্যেই দেশ স্বাধীন হয়ে যায়। আমিরুল- আমার সন্তান স্বাধীন দেশে জন্ম নেবে। আজ বাঙ্গালি জাতির বিজয় হয়েছে। আজ আমাদের বিজয়ের উল্লাস করার দিন।

স্বাধীনতার অনেক বছর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা করেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের কোঠা দান ও বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার বন্দোবস্ত করেন। মরিয়ম তখন আমিরুল কে বলে, তুমিও মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম দাও। আমিরুল- না, আমি বিনিময়ের আশায় কিছু করিনি। আমি তো দীর্ঘ ৫ মাস জেলেই বন্দি ছিলাম। আমার দেশ স্বাধীন হয়েছে এটাই আমার কাছে অনেক। আমার সন্তান স্বাধীন দেশে জন্মেছে। আমরা যে বিজয়ের উল্লাস করতে পেরেছি এর থেকে বড় পাওয়া আর হয় না। অন্য সব সুযোগ সুবিধা এর তুলনায় কিছুই না। তাই আমি সে সব সুযোগ সুবিধা চাই না।

স্বপ্নবিলাপ ডটকম এ জীবনের গল্প পড়ুন, বাস্তবতা সম্পর্কে জানুন।

5/5 - (1 vote)

Mehzabin Afroz Urmi

আমি মেহজাবিন, এখনো পড়াশোনা করি নিজের একটা পরিচয় করবো বলে । নাটোর জেলার গুরুদাসপুর থানার ছোট্ট একটা গ্রামে আমার বসবাস । লেখালেখির হাতে খড়িটা ঠিক কবে হয়েছিলো আমার মনে নেই, তবে লিখতে আমার ভীষণ ভালো লাগে, আর সারাক্ষন মাথার মধ্যে কিছু না কিছু একেই চলে । তাই যখনি অবসর সময় পাই তখনি মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাওয়া শব্দ গুলোকে পরিপূর্ণ রূপ দেয়ার চেষ্টা করি ।

x