Shopnobilap
সপ্তাহে ৫ দিন

সপ্তাহে ৫ দিন

প্রতিদিন সকালে ৩টা অ্যালার্ম-এ ঘুম ভাঙে, প্রথম ২টা অ্যালার্ম-এ লাফায় উঠি, মনে হয় গোলাবারুদের শব্দ শুনলাম যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে । শেষের এলার্ম-এ আরো একবার গোলাবারুদের শব্দে যখন ঘুম ভাঙে, ঘরের ছাউনির দিকে তাকিয়ে ভাবি যুদ্ধ কি শেষ? , আমি কি বেঁচে আছি ? হঠাৎ আরো একটি সতর্ক মূলক শব্ধ আমার মোবাইল থেকে আসে, আমি বুঝে যাই যে যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি, আমাকে ও অংশগ্রহণ করেতে হবে । চোখ ডলতে ডলতে ঘুম থেকে উঠে সকালটা শুরু হয় ওয়াসরুমে গিয়ে বিসর্জন দিয়ে । গতকাল যা খেয়ে ছিলাম যা পান করে ছিলাম, অবশিষ্ট অংশ টুকু রেখে আসতে হয় সেখানে । সবকিছু শেষে একদিকে চোখ ডলা, অন্য দিকে অফিস যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে, প্যান্ট শার্ট সব কিছু পড়া শেষ হঠাৎ অনুভব হয় ভেতরটা এমন খালি খালি লাগছে কেন? খেয়াল করে দেখি আন্ডারওয়ার পড়তে ভুলে গেছি । কখনো বা মাথায় চিরুনি দেয়ার জন্য আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখি শার্টএর বোতাম গুলো এলোমেলো করে লাগিয়েছি । এতকিছুর মধ্যে হঠাৎ পেটে মোচড়, মাছে ভাতে বাঙালি বলে কথা, সকাল হতে না হতেই খিদের চোটে পেট ব্যাথা করে । তবু ও কিছু করার নেই । হাতে একদম সময় নেই যে কিছু খেয়ে যাবো। এখনই বের হতে হবে যুদ্ধের উদ্দেশ্যে । প্রস্তুতি শেষ, ব্যাগ টা কাঁধে নিয়ে, রুম থেকে বের হওয়ার সময় প্যাকেট থেকে একটা বিস্কিট বের করে মুখে দিয়ে মনে হয়, ভালো হতো যদি চিবাইতে না হতো। বোতলের মুখ খুলে গলায় পানি ঢেলে কিছু অংশ জোর পূর্বক ঢুকিয়ে বের হতে হয় যুদ্ধে যাবার জন্য ।

বাসা থেকে নেমে, গলি থেকে বের হয়ে হাতের বামে মোর ঘুরতেই দেখি যুদ্ধ বেশ ভালোভাবেই লেগেছে, কেউ দৌড়াচ্ছে, কেউ বা দাঁড়িয়ে আসে নির্বিকারে আকাশের দিকে । নানান মানুষের যেন নানান রকমের ভঙ্গি । দেখে মনে হয় সবাই প্রতিবন্ধী, নিজেকে নিয়ে ভাবার মতো সময় সবাই হারিয়ে ফেলেছে, সবাই এখন যুদ্ধে ব্যাস্ত । ৪ মিনিট হাটতেই মেইন রাস্তা, ছোট বড়ো বিভিন্ন রকম গাড়ির বিভিন্ন রকম প্যা, পু শব্ধ। কোনো কোনো গাড়ি ব্রেক করলে মনে হয়ে শরীর থেকে তার সব অলংকার খসে পরে যাবে । মেইন রাস্তা থেকে হাতের ডানে ৫-৭ মিনিট আরো হাটতে হবে আমাকে । প্রতিটি ধাপ আমাকে যুদ্ধের দিকে ধাবিত করছে । খেয়াল করছি বেশ ভালো রকমেই বেঁধেছে যুদ্ধ ।

গাড়িতে গাড়িতে ঝোলা ঝুলি করে মানুষ চলাচল করছে, কেউ কেউ কাঁধে কিসব নিয়ে ঘুরছে বোঝা দায়। নানান রকম গাড়ি নামক বন্দুকের নানান রকম শব্দ হচ্ছে চারিদিকে । হঠাৎ পেছন থেকে প্যাপু শব্দ, চমকে ২ হাত ডান দিকে লাফিয়ে পেছন ঘুরতেই দেখি ভাঙ্গাচূড়া একটা গাড়ি । চালকটা মুচকি হেসে বলছে মামা ছড়ি। এদের কথা বাত্রা শুনলে আমার রীতিমতো সন্দেহ হয়, আমার কোন বোনের ছেলে ও আল্লাহ ই জানে । নাকি বাবার ডান পক্ষ, বাম পক্ষ বলে কিছু ছিল ।

৫ মিনিট হাঁটা শেষ, এবার শুরু হলো অপেক্ষা, আমাকে বাসে উঠতে হবে। একের পর এক গাড়ি চলে যাচ্ছে কারো যেন ব্রেক করার কোনো বালাই নেই । কে কি করছে না করছে, খেয়াল করার সময় ও কারো নেই। আমি ও সুযোগ সন্ধানী একটু ব্রেক করলেই লাফিয়ে উঠবো । কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ তাকাতেই দেখলাম একটা গাড়ি আসতেছে, আমি হাত তুলতেই পাশে এসে হালকা ব্রেক করতেই আমি সজোরে একলাফ। এই বুঝি প্রাণটা গেলো । একটু কম বেশি হলেই সোজা চাকার তলায়। ভাবতেই অবাক লাগে, রক্তে মাখা আমার নিথর দেহ রাস্তায় পরে থাকবে, কেউ থাকবে না দেখার মতো, হয়তো আইনের লোকের চোখে পড়লে জামা কাপড়ের মধ্যে কোনো ডকুমেন্ট পেলে আমার খোঁজ টা আত্মীয় স্বজন পাবে । আর যদি কোনো ডকুমেন্ট না থাকে তবে আমার মরা দেহ চলে যাবে মর্গে, আর যদি অবস্থা খুবই খারাপ থাকে তবে কিছু পরিচ্ছন্ন কর্মী এসে আমাকে নিয়ে গিয়ে ফেলবে ময়লার ডাস্টবিনে আর আমার লাল টগবগে রক্ত ধুয়ে দিবে পানি দিয়ে, ব্যাস কেল্লা খতম। আরো একটা প্রাণ শহীদ হলো।

এতো কিছু ভাবে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছি নিজেই জানিনা । চোখ খুলতেই দেখি সবকিছু শান্ত, এমনকি আমি নিজে ও । বুজে ওঠা ভার যে ঠিক কি হয়েছে, লাফিয়ে উঠে জানলা দিয়ে তাকাতেই বুঝতে পারলাম ট্রাফিক জ্যাম, ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখি ১ ঘন্টা পার হয়ে গেছে । অবশেষে ঘুম ভেঙে গেলো । গাড়ি চলছে তার আপন মনে আর আমি তাকিয়ে রাস্তার মানুষ গুলো কে দেখছি । নানান রঙের মানুষের বসবাস এই ব্যাস্ত শহরে । কেউ কেউ রাস্তায় পরে আছে ভূমিহীন হয়ে, কেউ কেউ এই শীতের সকালে বসে কাঁপছে। কেউ বা শিশুর খাবার জোগাড় করার উদ্দেশে আর্তনাদ শুরু করেছে। একদল লোক তাদের দেখে মজা নিচ্ছে, একদল ঘৃণা করছে আর একদল লোক নিজের খাবার তাদের সাথে ভাগাভাগি করে খাচ্ছে। আমি যে কোন দলের মধ্যে পড়ি তা নিজের ও জানা নেই। ওদের দেখলেই পরাজিত সৈনিক দেখতে কেমন হয় তার একটা নমুনা পাওয়াযায় । বড়ো অসহায় শহর এই ঢাকা, যেখানে জীবনের এতটুকু মূল্য ও নেই ।

আরও ১ ঘন্টা যেতে হবে আমাকে তবেই গন্তব্য স্থলে পৌঁছাতে পারবো । এমনিতেই মুখে সবসময় মাস্ক পরে থাকতে হয় অসুস্থ শরীর নিয়ে যুদ্ধে বেশিক্ষন টিকতে পারবোনা বলে, আগে থেকেই প্রস্তুতি । তারওপর আবার ঢাকা শহরের দূষিত হাওয়া আর পাবলিক বাস এ মানুষের ধাক্কা ধাক্কি, সিট এ বসে থাকলেও মনে হয় দাঁড়ায় আছি । এমনি ভাবে চড়ায় উৎরাই পেরিয়ে গন্তব্য স্থলের কাছ কাছি নামতে হয় । এখন থেকে আরো ১০ মিনিট হাঁটলে তবেই না পাবো কাঙ্খিত স্থান । মেইন রাস্তা থেকে হাতের ডানে ঢুকে লেকের পার দিয়ে পায়ে হেটে যাই আর বার বার সময় দেখি কত বাজে । একটু দেরি হলেই ১ দিনের মাইনে কাট করে কেটে নিবে । এমনিতেই যা পাই তা দিয়ে দিন ক্ষণ কেটে যায় আর কি, তার ওপর এইখান থেকে ১দিনের মাইনে কাটলেতো মাস শেষে টানাটানি পড়বে ।

এইভাবে ১৫ মিনিট পর কাঙ্খিত সেই স্থানে পৌঁছেই আরো একবার হাত ঘড়ির দিকে তাকাই। ঠিক সময় পৌঁছেছিতো? আর একটু সময় কি পাবো সকালের নাস্তাটা করার জন্য । কোনো দিন সেই সৌভাগ্যটা হয়তো হয়েছে, কোনো দিন সময় থাকলে ও উপায় থাকেনি । হয়তো কাছে টাকা নেই, নয়তো হাতে অনেক কাজের চাপ । যেদিন সুযোগ পেয়েছি সেদিনতো মহা খুশি । হোটেলে ঢুকে ১০টাকার ডাল আর ১০টাকার একটা রুটি আর এক গ্লাস পানি, কিজে মজা কাউকে বুঝানোটা দায় যে, বাড়িতে মায়ের হাতের সকালের সেই গরম ভাত, ভর্তা আর ঘি এখন কতটা মিস করি। নাস্তা শেষে হোটেল থেকে বের হতেই নিজেকে মনে হয় আম্বানীর ছেলে, রাজভোগ খেয়ে বেরহলাম। এমনিকরেই সকালটা পার হয় । কিছু সময় ব্যস্ততার মধ্যদিয়ে কাটে, তারপর শুরু হয় যুদ্ধ বিরতি, সবার সাথে হাসি ঠাট্টা, কথপোকথন এর মধ্যে দিয়ে বিরতি সময় টা পার হয় , কখনো বা বাহিরে টম দোকানের চা আর সিগারেটর ধোওয়ার সাথে দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে খোলা আকাশের বুকে তাকিয়ে থেকে তার বিশালতা দেখে বিরতি সময় পার হয় । বিরতি শেষেই আবার যে যার মতো পজিশন নিতে প্রস্তুত থাকে ।

সারা দিন, এভাবে হাসি ঠাট্টা, কথপোকথন, আর কাজের ব্যাস্ততার মধ্যদিয়ে কাটিয়ে দিন শেষে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাসায় ফিরে আয়নার সামনে দাঁড়াতে ভয় হয় । যদি নিজেকেই নিজে চিনতে না পারি । এতকিছুর পর ফ্রেশ হয়ে, রাতের খাবার শেষে বিছানার দিকে এগিয়ে যেতে যেন শরীরটা ভার হয়ে যায় । বিছানায় শুয়ে ঘরের ছাউনির দিকে তাকিয়ে প্রতিদিন শুধু কয়েকটি প্রশ্নই মনের মধ্যে জাগে যার উত্তর আজ জানিনেকো ।

কেন এই যুদ্ধ? কার বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ, বিপক্ষদলই বা কে, কখনো কি শেষ হবে এই যুদ্ধ?

5/5 - (13 votes)

Muradul Hasan

x